ঢাকা,সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪

শব্দদূষণে অতিষ্ঠ মানুষ, আইন আছে প্রয়োগ নেই, চাই সচেতনতা

নিজস্ব প্রতিবেদক ::

নগরজীবনে নানা ভোগান্তির সাথে উচ্চস্বরে মাইকের ব্যবহার রীতিমতো আতঙ্কের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। সামাজিক, ধর্মীয়সহ নানা অনুষ্ঠানে রাতভর উচ্চস্বরে মাইক বাজানো এখন নিত্যদুর্ভোগের অংশ হয়ে গেছে। বিয়ে–শাদীসহ সামাজিক অনুষ্ঠানে রাতভর মাইকে উচ্চশব্দে গান–বাজনার প্রবণতা দিন দিন বেড়েই চলেছে। এ নিয়ে প্রতিবাদ করলেই ঘটে অপ্রীতিকর ঘটনা।
পরিবেশবাদীরা বলছেন, শুধু আইন কিংবা নীতিমালা প্রণয়ণ করে শব্দদূষণ রোধ করা যাবে না। এরজন্য প্রয়োজন জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং আইনের কঠোর প্রয়োগ।
শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে নীতিমালা প্রণয়ণ করা হলেও তা বাস্তবায়নে গরজ বোধ করেন না কেউই। আবাসিক কিংবা শিল্প এলাকা কোথাও কেউ মানছেন না শব্দদূষণ আইন। দেখারও যেন কেউ নেই। ফলে প্রতিনিয়তই বাড়ছে শব্দদূষণ আর ভোগান্তিতে পড়ছেন নগরবাসী।
প্রয়োজন–অপ্রয়োজনে যানবাহনের মাত্রাতিরিবক্ত হর্ন বন্ধ হচ্ছে না আইন করেও। এর পাশাপাশি বিকট শব্দে মাইক ও সাউন্ড বক্স বাজিয়ে নগরীতে প্রায়ই চলে সভা সমাবেশ, ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠান।
নগরীর আসকারফদঘি এলাকার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক গৃহবধূ অভিযোগ করে বলেন, প্রতিবেশীর বিল্ডিংয়ে গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান হচ্ছে লাউড স্পিকার চালিয়ে। পরদিন ছেলের ভর্তি পরীক্ষা। বিকট শব্দের কারণে পড়াশোনা করতে পারছিল না আমার ছেলে। সাউন্ড একটু কমিয়ে দেয়ার কথা বলতেই আমুদে পরিবারটি ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। পাল্টা উত্তর দেয়, জীবনে বিয়ে তো আরেকটি হবে না। আনন্দ আজই করতে হবে। ঘরের দরজা ভাল করে বন্ধ করে দিন তাহলেই শব্দ আর যাবে না।
হারুন অর রশীদ নামে এক ব্যক্তি বলেন, জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে নগরীর আকবরশাহ এলাকায় একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে গান বাজনা শুরু হয় রাত ১০টার পর। রাত দেড়টার দিকে বর আসেন বাদক দল নিয়ে। বিয়ের অনুষ্ঠানস্থলে এসেই শুরু হয় বাজি ফোটানো। মুহুর্মূহু বিকট শব্দে মধ্যরাতে আশপাশের বাড়ির লোকজন ঘুম থেকে উঠে যান। শিশুদের কান্নাকাটি শুরু হয়ে যায়। কেমন অমানবিক অবস্থা বলুন। অথচ অদূরেই আকবরশাহ থানা।
শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালায় বলা আছে, কোনো উৎসব, সামাজিক বা রাজনৈতিক অনুষ্ঠানে লাউড স্পিকার, এমপ্লিফায়ার বা কোনো যান্ত্রিক কৌশল ব্যবহার করতে হলে কর্তৃপক্ষের পূর্বানুমতি লাগবে। এসব কার্যক্রম সর্বোচ্চ পাঁচ ঘণ্টার বেশি হবে না। পাশাপাশি রাত ১০টার পর কোনোভাবেই শব্দ দূষণকারী যন্ত্র ব্যবহার করা যাবে না বলেও উল্লেখ আছে এই বিধিমালায়। কিন্তু কে শোনে কার কথা। যে আইন করা হয়েছে নগরবাসীর কল্যাণে তা যেন পুরোই ফাইলবন্দি। শব্দদূষণের নিয়ন্ত্রণে যে সুনির্দিষ্ট আইন আছে সেটিও জানে না যেন কেউই। ফলে হরদম করে যাচ্ছেন শব্দদূষণ সংক্রান্ত কার্যকলাপ।
পর্যবেক্ষণে জানা যায়, শব্দদূষণের গুরুত্ব বিবেচনায় রেখে ১৯৯৭ সালের পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে শহরকে ৫ ভাগে ভাগ করা হয়। নীরব এলাকা, আবাসিক এলাকা, মিশ্র এলাকা, শিল্প এলাকা, বাণিজ্যিক এলাকায় দিন ও রাতভেদে শব্দের মাত্রা নির্ধারণ করা হয়। আবাসিক এলাকায় ৫০ ডেসিবেল, বাণিজ্যিক এলাকায় ৭০ ডেসিবেল, শিল্প এলাকায় ৭৫ ডেসিবেল, নীরব এলাকায় ৪৫ ডেসিবেল, আবাসিক কাম বাণিজ্যিক এলাকায় ৬০ ডেসিবেল, রাতের জন্য সর্বত্র ১০ ডেসিবেলের কম।
অথচ আইনে ঘোষিত এসব নীরব এলাকা এখন শব্দের শহরে পরিণত হয়েছে। মাত্রাতিরিক্ত শব্দদূষণের ফলে বিভিন্ন রোগব্যাধিতে ভুগছেন নগরবাসী। শব্দদূষণের জন্য বিধিমালা প্রণয়ন করা হলেও সে দূষণ এখন আর নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। যে জন্য নগরীর এমন দুর্দশা !
পরিবেশ অধিদপ্তর, চট্টগ্রামের পরিচালক (মেট্রো) আজাদুর রহমান মল্লিক বলেন, অভিযোগ পেলে আমরা অবশ্যই শব্দদূষণকারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে থাকি। এ ধরণের অভিযোগ খুব কম পাওয়া যায় বলে জানিয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক বলেন, পরিবেশ অধিদপ্তরের পাশাপাশি পুলিশ প্রশাসনকেও এ ব্যাপারে অভিযোগ করার সুযোগ আছে।
সমাজ পরিবর্তনের স্লোগানধারী স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন পরিবর্তন ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের চেয়ারম্যান নওশাদ চৌধুরী বলেন, আইন দিয়ে শব্দদূষণের এই প্রবণতা রোধ করা যাবে না। এজন্যে সচেতনতা খুবই জরুরি। জনগণকে সচেতন করা হলে আর আইনের প্রয়োজন হবে না।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ৬০ ডেসিবেল শব্দে মানুষের সাময়িক শ্রবণশক্তি নষ্ট হতে পারে এবং ১০০ ডেসিবেল শব্দে চিরতরে শ্রবণশক্তি হারাতে পারে।
পরিবেশবাদীরা বলেন, শুধু আইন কিংবা নীতিমালা প্রণয়ণ নয়। শব্দদূষণ রোধে প্রয়োজনীয় জনসচেতনতা বৃদ্ধি ও কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। অতিদ্রুত এটি নিয়ন্ত্রণ করা না হলে ভবিষ্যতে আরও ব্যাপক বিপর্যয়ের সৃষ্টি হবে। এর বিরূপ প্রভাব পড়বে নাগরিকদের শরীরে।

পাঠকের মতামত: